শোককে শক্তিতে পরিণত করার শপথ

 

বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির দুই দিন আগে দেশের সূর্যসন্তানদের বেদনাচিত্তে স্মরণ করল গোটা জাতি। বুদ্ধিজীবীদের হারানোর বেদনা সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে গেল আরেকবার। তাদের হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার শপথ নেওয়া হলো। কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের স্মরণ করা হলো। রাজধানীর মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে শহিদবেদিতে শ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের মানুষ। এদিন বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের রক্ষা করছে তাদের আশ্রয়দাতা দেশগুলো। নিজস্ব আইনের দোহাই দিয়ে তাদের রক্ষা করা হচ্ছে। তারা আরও বলেন, পরাজিত শক্তিগুলো এখনো ষড়যন্ত্র করছে। তাদের সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের হাতে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হন দেশের চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পী ও চিন্তাবিদ। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতেই তাদের হত্যা করা হয়। দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে। এছাড়া আলোচনাসভার আয়োজন করে অনেক দল ও সংগঠন।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে। মঙ্গলবার সকালে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতির পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এসএম সালাউদ্দিন ইসলাম। আর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকীব আহমেদ চৌধুরী। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বাজানো হয়। সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকশ দল সামরিক কায়দায় সালাম জানায়। পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। এরপর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সর্বসাধারণ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে শহিদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং যুদ্ধাহত ও উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সকাল ৭টা ২২ মিনিটে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় মোজাম্মেল হক বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত ঘাতকরা বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে পালিয়ে রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো-আশ্রয়দাতা দেশগুলো তাদের দেশের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও নিজস্ব আইনের কথা বলে তাদের হস্তান্তর করছে না। নিজস্ব আইনের দোহাই দিয়ে ঘাতকদের রক্ষা করছে।

মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এরপর মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিসহ সব আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার ডাক দেওয়া হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে আমরা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক সেই সময় বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। নানক আরও বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও একাত্তরের পরাজিত শক্তিগুলো ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। আজও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে এ বাঙালি জাতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে-এটিই বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রত্যয়।

দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা। শহিদ বুদ্ধিজীবীর চেতনা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, শুধু ঢাকায় নয়, জেলায় জেলায় বুদ্ধিজীবীদের ধরে হত্যা করা হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধীদের সন্তানরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে, তারা আন্তর্জাতিকভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। আর যেসব দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার আসামিরা রয়েছে, সেসব দেশে বঙ্গবন্ধুর খুনিরাও রয়েছে। তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শাজাহান খান, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবুউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, শাহাবুদ্দিন ফরাজী, সৈয়দ আব্দুল আউয়াল শামীম, আনিসুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতারা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহিদদের প্রতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি, গণফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মোহসীন মন্টু ও সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের নেতৃত্বে যুবলীগের নেতাকর্মীরা সকাল সাড়ে ৮টায় মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর সকাল ৯টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে এবং সকাল সাড়ে ৯টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহিদদের প্রতি তারা শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন।

রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি বিভিন্ন সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সুতরাং পরিপূর্ণভাবে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার মাধ্যমে এ দেশ থেকে আমরা তাদের পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করতে পারব।
 

Post a Comment

0 Comments